নিজস্ব সংবাদাতা, কলকাতা
Globalnewz.online
বুধবার, ৪ঠা অক্টোবর,২০২৩
কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণের উপায় : একটি সমাজতাত্ত্বিক পর্যালোচনা
সম্প্রতি সময়ে সমাজের মধ্যে যে সমস্যাটি সিংহভাগ লক্ষ করা যাচ্ছে তাহল শিশু ও কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা।এই কিশোর দুষ্ক্রিয়তা (Juvenile Delinquency) বর্তমান সময়ে সমাজের একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।বিশ্বায়নের ফলে সমাজে যতই শিল্পায়ন,নগরায়ন এবং প্রযুক্তির পরিমাণ বাড়ছে ততই কিশোর অপরাধের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে।যা এক সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েগেছে।পাশ্চাত্য দেশ গুলির পাশাপাশি আমাদের ভারতবর্ষের মত উন্নয়নশীল দেশ গুলিতেও এই সমস্যা ক্রমশ মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।সাধারণভাবে বলা যায় যে, কিশোর দুষ্ক্রিয়তা বা অপরাধ বলতে কিশোর কর্তৃক সংঘটিত এমন কাজকে বোঝায় যা সমাজ ও আইন কর্তৃক অসমর্থিত। সামাজিক মূল্যবোধ ও আইনবিরোধী কাজ কিশোর বয়সীদের দ্বারা সংঘটিত হলে তা কিশোর-দুষ্ক্রিয়তা বা কিশোর অপরাধ হিসাবে পরিগণিত হয়।এক কথায়,কিশোররা যখন সমাজবিরোধী ,অনৈতিক এবং আইন বিরোধী কাজকর্ম করে থাকে তাকে বলা হয় কিশোর অপরাধ।বয়সের দিক থেকে সাধারণ ৭ থেকে ১৬ বছর বয়সী কিশোর কিশোরী দ্বারা সংঘটিত অপরাধই কিশোর অপরাধ। তবে বিভিন্ন দেশে বয়সের তারতম্য রয়েছে। কোনো কোনো দেশে ১৩ থেকে ২২ বছর আবার কোনো দেশে ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী কেউ অপরাধ করলে কিশোর অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হয়।এই প্রসঙ্গে Cyril Burt বলেছেন, কিশোর দুষ্ক্রিয়তার ধারণা অনুযায়ী ‘অসামাজিক প্রবণতার কারণে কিশোর বয়সীদের কোনো কাজের বিরুদ্ধে যখন আইনানুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ দরকার হয়ে পড়ে, তখন তা কিশোর-দুষ্ক্রিয়তা হিসাবে পরিগণিত হয়’।
এই কিশোর অপরাধ এর কিছু বিশেষ বিশেষ কারণও রয়েছে।কিছু বিশেষ বিশেষ বিষয়ের জন্য শিশু বয়সে কিশোররা নানান অপরাধ মূলক কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে।এই কারণ গুলো এবার আলোচনা করবো।কিশোর বয়সে অপরাধের কারণ গুলি হল-
ক)চরম দারিদ্রের জন্য কিশোররা অপরাধ মূলক কাজ করে থাকে।যখন তারা ভালোভাবে পেট ভরে দু-মুঠো ভাত খেতে পায় না তখন পেটের দায়ে তারা বিভিন্ন অপরাধ করে থাকে।যেমন-ছিনতাই,চুরি, রাহাজানি,চোরাকারবার প্রভৃতি।
খ)সঠিক শিক্ষার অভাবেও বাচ্চারা কিশোর বয়সে অপরাধ করে থাকে।শিক্ষা মানুষের মনে জ্ঞানের আলো নিয়ে আসে।কিন্তু যখন শিশুরা এই শিক্ষার আলো না পায় তার জন্য তারা সমাজের মূল স্রোত থেকে অনেক সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ও নানান অপরাধ করে ফেলে।
গ)পারিবারিক পরিবেশ ভালো না হলে শিশুর সামাজিকীকরণে বাধা আসে।যেমন- পরিবারের ভাঙ্গন,পারিবারিক ঝগড়া,মারামারি, অশান্তি,পিতা-মাতার ডিভোর্স প্রভৃতির ফলস্বরূপ একজন কিশোর অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে।কারণ ওই পরিবেশে তার সামাজিকীকরণ এর বিষয়টি ভালো হয়না।
ঘ)বিভিন্ন সিনেমা,সোশ্যাল মিডিয়ার নানান বিষয়ও কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়িয়ে দেয়।
ঙ)কথায় আছে, “সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।” অর্থাৎ কিশোর বয়সে বাচ্চারা অনেক সময় ভুল বন্ধু-বান্ধবীর পাল্লায় পড়ে থাকে অর্থাৎ ভুল মানুষকে সহচর হিসাবে গ্রহণ করে।এরফলে, ওই ভুল সঙ্গীর সাথে থেকে কিশোররা নানান অপরাধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে।
চ)এছাড়াও সামাজিক ও মানসিক সমস্যার জন্য একজন কিশোর অপরাধ করে ফেলে।যদি শিশু বয়স থেকে কিশোরদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশ ভালো না হয় তখনও এই অপরাধের সংখ্যা বেড়ে চলে।বাড়ির লোকজন বিশেষ করে বাবা-মা যদি সন্তানের প্রতি যত্নশীল নাহয় বা সন্তানদের পর্যবেক্ষণ না করেন তখনও কিশোর অপরাধের সংখ্যা বাড়ে।
● এই কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণের উপায়-
কিশোর অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ এর জন্য সরকারি এবং বেসরকারি সমস্ত সংস্থাকে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে।বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।সরকার কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য দুটি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন।এগুলি হল- কিশোর আদালত (Juvenile Court) এবং রিফর্মেটরী স্কুল (Reformatory School)।
এর পাশাপাশি,সরকার নানান ব্যবস্থা নিচ্ছেন কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য। ১৮৭৬ সালে রিফর্মেটরি স্কুল অ্যাক্ট চালু হয় এবং ১৮৮৭ সালে তার অ্যামেন্ডমেন্ট হয়। এটিই ছিল কিশোর অপরাধকে দূর করার প্রথম সুপরিকল্পিত সরকারি পদক্ষেপ। ১৯১৯-২০ সালে কিশোর অপরাধীদের শুদ্ধির জন্য ভারতীয় জেল কমিটি (Indian Jails Committee) তৈরী করা হয়েছিল। ১৯২০ সালে শিশু আইন (Children Act), বরস্ট্যাল আইন (Borstal Act)-কে স্থান দেওয়া হয় বাংলা, বম্বে, মাদ্রাজ ও কোচিনের স্ট্যাট্যুট বইয়ে।এছাড়াও ১৯৫৪ সালে হায়দ্রাবাদে পাশ হয় প্রবেশন অ্যাক্ট (Probation Act)। তবে এই কিশোর অপরাধ প্রতিরোধ করতে হলে এই সকল আইনি বিষয়ের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারিভাবে আরও যে সমস্ত পদক্ষেপ গুলো গ্রহণ করতে হবে সে গুলি হল-
১)শিশুদের শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে।যাতে সবাই কম-বেশি পড়াশোনা করতে পারে।
২)দারিদ্র্য অবসানের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।কারণ দারিদ্র্য দূরীকরণ না করলে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
৩)কিশোরদেরকে সু-নাগরিক করে তোলার জন্য বিভিন্ন এনজিও কে এগিয়ে আসতে হবে।শহর থেকে শুরু করে প্রান্তিক গ্রামে গ্রামে এই বিষয়ে ক্যাম্প করতে হবে।শিশুদেরকে এই অপরাধ নিয়ে সচেতন করাতে হবে।তাদেরকে ভালোভাবে এই অপরাধের কুফল সম্পর্কে বোঝাতে হবে।
৪)সরকারি ও বেসরকারিভাবে গরিব কিশোরদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র,স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের ব্যাবস্থাও করে দিতে হবে।
৫)শিশুদের জন্য বিনামূল্যে কাউন্সেলিং পরিষেবা চালু করতে হবে।এজন্য বিভিন্ন এনজিওদেরকে উদ্যোগ নিতে হবে।
৬)প্রত্যেক পিতা-মাতার উচিত শিশুদেরকে সর্বদা পর্যবেক্ষণে রাখা।তারা কি করছে,কোথায় যাচ্ছে প্রভৃতির উপর নজর দেওয়া।শিশুদের সমাজিকীকরণ যাতে ভালো হয় সেদিকে লক্ষ রাখা।শিশুদের ভুল গুলোকে ধরিয়ে দিয়ে তাকে সঠিক শিক্ষা দেওয়া এবং সঠিক পথে নিয়ে আসা।তার জন্য কিশোরদেরকে শাসন এবং বোঝাতে হবে।
৭)এছাড়াও কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারিভাবে বিভিন্ন আইন চালু করা।
৮)স্কুলে স্কুলে এবং চিকিৎসা কেন্দ্রে ‘সোশ্যাল ক্লিনিক’ এবং ‘সমাজিক ডাক্তারের’ বিষয় গুলোকে চালু করা।
৯)প্রাথমিক থেকেই শিশুদেরকে সমাজবিদ্যা এবং সমাজকর্ম বিষয়ক জ্ঞান প্রদান করা।
১০)কিশোর অপরাধীদের অবজ্ঞা, লাঞ্চনা,অপমান, ঘৃণা না করে তাদেরকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য সামাজিক ও মানসিকভাবে সবাইকে পাশে থাকতে হবে,তাদেরকে বোঝাতে হবে।যাতে সে পুনরায় আর অপরাধ না করে।
১১)দেশে পর্যাপ্ত কিশোর অপরাধ সংশোধন কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।
●(জয়দেব বেরা একজন তরুণ কবি,প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী ,সমাজতত্ত্বের গেস্ট লেকচারার এবং সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক)