দোষারোপ করা বা ব্লেমিং সমস্যার ম্যানেজমেন্ট
বিশেষ প্রতিনিধি, মেদিনীপুর,
Global Newz, Kolkata
(অতিথি অধ্যাপক,বই লেখক ও সমাজচিন্তক)
দোষারোপ করা বা ব্লেমিং(Blaming)-এটি হল এক ধরনের ভুল চিন্তাভাবনাগত সমস্যা।এই সমস্যা বর্তমান সময়ের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে অনেকাংশে লক্ষণীয়।যদিও এটি কোনো মানসিক রোগ নয়,তবে এটি একধরনের মানসিক চিন্তাভাবনাগত ত্রুটি বা সমস্যা।যা দীর্ঘদিন স্থায়ী হলে বা চলতে থাকলে ব্যক্তির নানান ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।ব্যক্তি অবসাদ,হতাশায় ও হীনমন্যতায় ভুগতে পারে।সামাজিক ও মানসিকভাবে অনেকটাই দুর্বল হয়ে যেতে পারে।এর ফলশ্রুতি হিসাবে ব্যক্তি নানাবিধ মানসিক জটিল সমস্যায় ভুগতে পারে।এছাড়াও এই সমস্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে বর্তমান সময়ে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সম্পর্ক বিচ্ছেদ,একাকীত্ব,আত্মহত্যা প্রভৃতি বিষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে।তাই এই ব্লেমিং সমস্যার ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে জেনে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দোষারোপ করা বিষয়টি মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে।এক,সবসময় অন্যের দোষ দেখা বা অন্যকে দোষ দেওয়া এবং দুই,সর্বদাই নিজেকে দোষী ভাবা।অর্থাৎ প্রথম ক্ষেত্রে দেখা যায়, এক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজের কাজের ভুল কখনোই দেখতেই পায় না। সে তার জীবনে যাই কিছু ঘটুক না কেন অন্যকে তার জন্য দোষারোপ করেন বা দায়ী করেন। তিনি মনে করেন তিনি ভুল করতেই পারেন না।তিনি ঠিক আর অন্যেরা ভুল।প্রতিটি বিষয়ে অন্যকে দোষারোপ করে থাকেন।আর নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা করেন।এটি সবসময়ই হয়ে থাকে।জীবনে ঘটে যাওয়া প্রত্যেক ঘটনাকে কোনো বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন না করেই সবসময় বিপরীত পক্ষকে দোষারোপ করেন।এর ফলে সর্বদাই অন্যদের সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হয় এবং আচরণে সমস্যা আসে।যার দরুন ব্যক্তি রাগ, হতাশা ইত্যাদি সমস্যায় ভুগতে থাকেন।অন্যদিকে, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দেখা যায়,এক্ষেত্রে ব্যক্তি মনে করেন তার জীবনে যেকোনো ভুল ভ্রান্তির জন্য কেবল তিনি দায়ী। নিজেকে এক্ষেত্রে তিনি দোষারোপ করে যান।অন্যের ভুল,দোষ থাকলেও তিনি সেটাকে মানতে চান না।তিনি সর্বদাই নিজের দোষ দেখেন।এমনকি অন্যের দোষ বা ভুল-ত্রুটি থাকলেও নিজেকে দোষী হিসাবে মনে করেন।এর জন্যও কিন্তু মনে হতাশা ও অপরাধবোধের সৃষ্টি হয়।
এবার দুটি বিষয়কে উদাহরণ এর মধ্য দিয়ে বোঝার চেষ্টা করবো।প্রথম ক্ষেত্রের উদাহরণটি হল : ধরুন রিয়ার অভ্যাস হল ঘন ঘন বয়ফ্রেন্ড চেঞ্জ করা।বেশিদিন একই ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক তার একঘেঁয়ে লাগে।কিছু একটা হলেই বয়ফ্রেন্ডকে দোষ দেওয়া। কোনো না কোনো একটা ভুল-ত্রুটি সে ধরবে এবং কিছু না কিছু নিয়ে সে অশান্তি করবেই এবং তারপরই সে আর ঐ সম্পর্কে থাকতে চাইবে না। তার সাথে কথা বললেই জানা যায় যে,সে কোনো কিছুতেই নিজের কোনো দোষ দেখতে পায় না। যা কিছু খারাপ কাজ, অন্যায়, ভুল সবই ঐ বয়ফ্রেণ্ড করে থাকে। তাই সে বাধ্য হয় সম্পর্ক থেকে সরে যেতে। এইভাবে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতে পেরে নিজেকে একদিকে যেমন নিজের অবচেতন মনের ইচ্ছা নিত্যনতুন সম্পর্ক তৈরি করে আনন্দ পাওয়া তা পূরণ করছে, আবার অন্যের দোষ দেখতে পায় বলে সম্পর্ক ভেঙে গেলে অন্য মানুষটির যে যে কষ্ট হয় তা সে বুঝতেই পারে না।এর ফলে তার নিজের মনে কোনোরকম কষ্ট, দুঃখ, সিমপ্যাথি, অপরাধবোধ কিছুই হয় না।অর্থাৎ এক্ষেত্রে দেখা যায় সম্পর্কের মধ্যে কিছু একটা সমস্যা হলেই বা কিছু ঘটনা ঘটলেই তা বয়ফ্রেন্ড এর দোষ হয়ে যায় এবং নিজেকে নির্দোষ দাবী করে।এটা কিন্তু সবক্ষেত্রেই হয়ে থাকে।কোনো যুক্তিবোধ,আলাপ-আলোচনা, বোঝাপড়া ইত্যাদি নাকরেই অন্যকে দোষারোপ করে থাকে।এর ফলে দুজনের মধ্যে নানান ঝামেলা, মানসিক অশান্তি,অবসাদ এমনকি সম্পর্ক বিচ্ছেদ ও আত্মহত্যার মত ঘটনাও ঘটে যায়।এই রকম সবসময় হলে বুঝতে হবে ব্যক্তি ব্লেমিং সমস্যায় ভুগছেন।যদিও এটি কেবল বয়ফ্রেন্ড নয়, প্রায় সবার সাথেই করে থাকবে।
আর দ্বিতীয় উদাহরণটি হল,রহিত কিছুতেই অন্যের দোষ দেখতে পায় না। যা কিছু এদিক ওদিকে হবে দৈনন্দিন কাজকর্মে তাতে সে সবসময় নিজেকে দোষী করে।যুক্তির মধ্য দিয়ে সে অন্যের দোষ বিচার করেনা।এর ফলে সে অপরাধবোধ,হীনমন্যতায় এবং হতাশায় ভোগে।তাই এটাও একটি ব্লেমিং সমস্যা।বিনা কারণে সবসময় নিজেকে দোষী ভাবা উচিত নয়।
এবার জানবো কীভাবে সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক উপায়ে এই ব্লেমিং সমস্যাকে ম্যানেজমেন্ট করা যেতে পারে।এই রকম সমস্যা হলে প্রথমে যেটা করতে হবে সেটি হল, মনে মনে এটা মেনে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে যে ব্লেমিং করা হল এক ধরনের চিন্তার ভ্রান্তি।নিজেকে সবসময় চেষ্টা করতে হবে ‘সেলফ টক’ এর মাধ্যমে সঠিক যুক্তির অনুসন্ধান করা।যথাযথ প্রমাণ যোগাড় করা।তার উপর ভিত্তি করেই দোষ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া।যাকে দোষী বলে ব্লেমিং করবো তার বিরুদ্ধে যেন যথাযথ প্রমাণ থাকে।এছাড়াও ব্লেমিং সমস্যাকে ম্যানেজমেন্ট করতে হলে আমার মতে, “LUSC” বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। যেখানে L হল ‘Logic’ , U হল ‘Understanding’, S হল ‘Sharing’ এবং C হল ‘ Caring’।এই বিষয়টি মূলত পার্সোনাল সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব বেশি প্রযোজ্য।এই চারটি বিষয় উভয়ের মধ্যে থাকলে তাহলে ব্লেমিং সমস্যা অনেকটাই কমে যেতে পারে।তারপরও এই সমস্যা খুব গভীর হলে একজন ভালো সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলর এর সহায়তা নিতে হবে।এই সমস্যায় এলবার্ট ইলিস এর ‘REBT’ (Rational Emotive Behavior Therapy) বিশেষ উপযোগী হতে পারে।এছাড়াও সকালে মেডিটেশন করুন,ব্রিদিং এক্সসারসাইজ করুন,নৈতিক ও ধর্মীয় শাস্ত্র অধ্যয়ন করুন,মোটিভেশানাল লেকচার শুনুন এবং সর্বশেষ নিজের চিন্তা-ভাবনা পরিবর্তন করার চেষ্টা করুন।