নিজস্ব সংবাদাতা, কলকাতা
Globalnewz.online
বুধবার, ৪ঠা অক্টোবর,২০২৩
নারী পাচার সমস্যা
(গেস্ট লেকচারার, সমাজতত্ত্ব,
সেবাব্রত ইনস্টিটিউট অফ নার্সিং এবং গভর্মেন্ট কলেজ অফ নার্সিং,উলুবেড়িয়া ও মাতঙ্গিনী গভর্নমেন্ট কলেজ অফ নার্সিং,তমলুক)
যখন অসৎ উপায়ে মেয়েদেরকে নানান প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য কিছু অসাধু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এক দেশ বা এক রাজ্য থেকে অন্য দেশে বা রাজ্যে স্থানান্তর করে দেয় তখন তাকে বলা হয় নারী পাচার(Women Trafficking)।এই কাজ কোনো একজন ব্যক্তি করে না,এক বা একাধিক গোষ্ঠী বা চক্রের মাধ্যমে হয়ে থাকে।এই চক্রকে বলা হয় পাচার চক্র।প্রথমে একদল মানুষ অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো গরিব মেয়েদের পরিবারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করে।তারপর তাদেরকে অর্থের লোভ,ভালো বিয়ে,চাকরির প্রতিশ্রুতি, সিনেমায় চান্স করে দেওয়া প্রভৃতির লোভ দেখিয়ে সুযোগ বুঝে পাচার চক্রের সবার সাহায্য নিয়ে ভিন্ন রাজ্যে বা দেশে পাচার করে দেয়।তাদের সাথে মূলত যৌন অত্যাচার করা হয়ে থাকে।সম্প্রতি সময়ে, এই নারী পাচার শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি এখন আন্তর্জাতিক একটি সমস্যা। আর এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা ছড়িয়ে আছে সাধারণ মানুষের ভিড়ে। এদের জাল রাজ্য, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য দেশেও বিস্তৃত, প্রসারিত।এই সমস্যাটি বর্তমানে অনেক বেশি ভয়াবহ। বিশাল আন্তর্জাতিক চক্র, মাফিয়া ডন, শিক্ষিত ক্ষমতাশীল অসাধু ব্যক্তি ও নেতারা এর সঙ্গে যুক্ত।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) মানব পাচার সহ অপরাধ সংক্রান্ত তথ্য সঙ্কলন করে ‘ভারতে অপরাধ’ শীর্ষক বিষয়ের ওপর একটি তথ্য প্রকাশ করেছে। এনসিআরবি-এর ওয়েবসাইট https://ncrb.gov.in -তে ২০২০ সাল পর্যন্ত এবিষয়ে সর্বশেষ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। ১০১৮ থেকে ২০২০-র মধ্যে ১৮ বছরের নীচে নারী ও শিশু পাচারের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০১৮ সালে ১৮ বছরের নীচে নারী পাচারের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৬৪ এবং শিশু পাচারের সংখ্যা ছিল ৯৪১। এই সংখ্যা ২০১৯-এ কমে যায়। পরে ২০২০-তে ১৮ বছরের নীচে নারী পাচারের সংখ্যা আরও কমে ৭৮৪ এবং শিশু পাচারের সংখ্যা কমে ৭৫০-এ দাঁড়ায়।
মহিলাদের পাচার করে মূলত এদের বাধ্য করা হয় যৌনকর্মী হিসাবে কাজ করতে। যার আয়ের সিংহভাগই পাবে তার মালিক যে তাকে অর্থের বিনিময়ে কিনেছে। কোথাও আবার তাদের বাধ্য করা হয় গৃহকর্ম বা অন্য কোনো কাজে শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে। নানা ধরনের অত্যাচার ও শোষণের শিকার হতে হয় তাদের। অনেক সময় স্থানীয় পাচারকারী থেকে রাজ্য, দেশ হয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ কিছু হাত ঘুরে এইসব পাচার হওয়া মেয়েরা পৌঁছে যায় বিদেশেও। এমনিভাবে ভারতের বিভিন্ন প্রাপ্ত থেকে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, দুবাই ও আরব দুনিয়ার বিভিন্ন শহরে ভারতীয় নিম্নবিত্ত গরিব পরিবারে মেয়েরা পাচার হয়ে যায় ‘চেইন সিস্টেমে’। সুতরাং এই জঘন্যতম অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে মহিলাদের শিক্ষা ও দারিদ্র্যের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে। এভাবে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই মেয়েদের ভালো খাওয়া-পরা, বিলাসবহুল জীবনযাত্রার লোভ দেখিয়ে, চাকরির লোভ দেখিয়ে, সু- পাত্রের সঙ্গে বিবাহের ও সামাজিক নিরাপত্তার লোভ দেখিয়ে,সিনেমায় নায়িকা ও মডেলিং বানানোর লোভ দেখিয়ে পাচার করা হয় মোটা অর্থের বিনিময়ে।
নারী পাচার একটি জঘন্যতম অপরাধ।এই অপরাধকে প্রতিরোধ করার জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে (NGO) বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।বিভিন্ন আইনও পাশ করানো হয়েছে।নারী পাচার প্রতিরোধ করার জন্য যে সমস্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলি হল-
১)সামাজিক সমতা, সামাজিক স্বীকৃতি, শিক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার পেলে নারী পাচার নিবারণের কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। সুতরাং সরকার ও সমস্ত জনসাধারণকে এই ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হবে। এবং নারীর ন্যায্য অধিকার ও সুযোগ তাকে দিতে হবে। পুরুষদের সঙ্গে নিয়ে নারী পাচার প্রতিরোধ কমিটি তৈরি করে গ্রামে গ্রামে নারী পাচার বন্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২)নারীদেরকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে হবে।কারণ দারিদ্র্য হল নারী পাচারের অন্যতম কারণ।তাই মেয়েদেরকে অর্থনৈতিক ভাবে অর্থাৎ উপার্জনের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসম্পন্ন করে তুলতে হবে।তাহলে তাদেরকে অন্য কেউ টাকার প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করতে পারবে না।
৩)নারী পাচার প্রতিরোধ করতে হলে কঠোর আইনি ব্যবস্থা চালু করতে হবে।কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।পাচার প্রতিরোধ করতে হলে আইনি ব্যবস্থা দরকার, অপরাধীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। তেমনি আইন করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত পরিচিত বা অপরিচিত কোনো নারী বা পুরুষের কথার ওপর বিশ্বাস করে এরকম ক্ষেত্রে কোনো মেয়ে বা মহিলা বাড়ি ছাড়ার আগে স্থানীয় পুলিশ প্রশানকে সব তথ্য জানাবে এবং তাদের সম্মতিতে সেই ব্যক্তির সঙ্গে কোথাও যেতে পারবে। এতে অন্তত প্রশাসন একটু খোঁজখবর নিয়ে বা এর সত্যতা যাচাই করার কিছুটা সুযোগ পাবে।এই নারী পাচার প্রতিরোধ করার জন্য সাপ্রেশন অফ ইমমরাল ট্রাফিক অ্যাক্ট ১৯৫৬ চালু হয় সারা ভারতে।
এই আইনের ফলে, মহিলা ও মেয়ে পাচারও একটি ক্রিমিনাল অপরাধ বলে গণ্য হয়। এর আগে ১৯৩৩ সালে বেঙ্গল সাপ্রেশন অফ ইমমরাল ট্রাফিক আইন, ১৯৩৩ চালু হয়েছিল। এই আইনে মূল্যবান সামগ্রী, মহিলা, শ্রমিক, ইত্যাদির চোরাচালান অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। বর্তমানে ইমমরাল চোরাচালান আইনের ফলে অপরাধীর জরিমানা ও স্বশ্রম কারাদণ্ডের ব্যবস্থা আছে। এই ধরনের অপরাধ গুরুতর ক্রিমিনাল অপরাধের অন্তর্ভুক্ত।
৪)আইন প্রয়োগকারী প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, আইনজীবী, ডাক্তার, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, ক্লাব, গ্রাম পঞ্চায়েত ও সকলকে নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধে এগিয়ে আসা।প্রয়োজনে উপযুক্ত আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
এর পাশাপাশি,গণমাধ্যমকে বেশি করে পাচার বিরোধী বিষয় গুলো নিয়ে প্রচার করতে হবে।
৫)প্রত্যেক জেলা থেকে প্রশাসনিকভাবে গ্রামে গ্রামে গিয়ে নারী পাচার নিয়ে সচেতনত মূলক ক্যাম্প করতে হবে।বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই বিষয় নিয়ে মেয়েদেরকে বোঝাতে হবে ও সচেতন করতে হবে।
৬)প্রত্যেক বিদ্যালয়ে তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই নারী পাচার এর সমস্যা নিয়ে সেমিনার বা বিভিন্ন আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত করতে হবে।নারী পাচারের ভয়াবহতা নিয়ে সমস্ত শিক্ষার্থীদেরকে জানাতে হবে ও বোঝাতে হবে।
৭) সরকার সহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গুলোকে নারী পাচার প্রতিরোধ করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।জনগণকে এই বিষয়ে সচেতন করাতে হবে।