গর্ভাবস্থায় পরিচর্যা
জয়দেব বেরা
(মেডিক্যাল কলেজের অতিথি অধ্যাপক, বই লেখক,সমাজচিন্তনক, সম্পাদক, সমাজকর্মী এবং MIND WELLNESS ACADEMY এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান)
মাতৃত্ব প্রত্যেক মায়ের কাছেই গর্বের বিষয়।মাতৃত্ব মায়েদের কাছে এক অলংকার এবং অহংকার।তাই এই সময় মহিলাদের খুব সাবধানে থাকতে হয় এবং পরিচর্যার মধ্যে থাকতে হয়।এই গর্ভবতী মহিলাদের প্রাক্-প্রসবকালীন সময়ে অন্তত 3 বার স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্বারা পরীক্ষা হওয়া প্রয়োজন। প্রথমবার-প্রথম 3 মাসের মধ্যে, দ্বিতীয়বার – 6 মাসের পরে এবং তৃতীয়বার বা শেষ বার- 9 মাসের মাথায়। যদি কোনো গর্ভবতী মহিলার কোনো সমস্যা বা ঝুঁকি থাকে তবে তাঁকে আরও ঘনঘন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হবে, তবে এ ব্যাপারে এ.এন.এম.(ANM) বা চিকিৎসকদের পরামর্শ প্রয়োজন। প্রত্যেক গর্ভবতী মহিলার স্বাস্থ্যপরীক্ষার সময় রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা এবং উচ্চতা মাপা অবশ্য প্রয়োজন। প্রত্যেক গর্ভবতী মহিলার, তিনি গর্ভবতী হওয়ার পর যথাশীঘ্র সম্ভব, নিকটবর্তী উপকেন্দ্রের এ.এন.এম-এর কাছে নাম রেজিস্ট্রিভুক্ত করা উচিত। স্বাস্থ্যপরীক্ষার সময়ই 100টি আই. এফ. এ. ট্যাবলেট এবং 2টি টি. টি. প্রতিষেধক দিতে হবে গর্ভবতী মহিলাদের।
● যে সমস্ত খাদ্য গ্রহণ করবেন:-
এই সময় সুষম খাদ্য অর্থাৎ বিন, সিম, কড়াইশুঁটি, বাদাম, আলু, চাল, ডাল, পাউরুটি, রুটি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ঘি, দই, সয়াবিন, তেল, মাখন এবং পেঁপে, আম, পেয়ারা জাতীয় ফল এবং গাজর, বাঁধাকপি জাতীয় সবজি খাওয়া উচিত।এছাড়াও স্থানীয়স্তরে পাওয়া যায় এমন খাবার খাওয়া উচিত যেমন—
◆আয়রন – পাঁঠার মাংস, ডিম, গাঢ় সবুজ রঙের সবজি যেমন কুলেখাড়া পাতা, মটরশুঁটি ইত্যাদি।
◆ভিটামিন এ- দুধের দ্বারা প্রস্তুত খাদ্য, ডিম, গাজর, পেঁপে ইত্যাদি।
◆ক্যালশিয়াম ম্যাগনেসিয়াম – দুধ, গাঢ় সবুজ রঙের সবজি, বিন, মশুর ডাল ইত্যাদি। খাদ্যশস্য, গাঢ় সবুজ রঙের সবজি, চীনাবাদাম ইত্যাদি।
◆ভিটামিন সি-কমলালেবু, টম্যাটো এবং অন্যান্য লেবুজাত বা অম্ল ফল।
সুতরাং, ভালো হজমের জন্যই হালকা আবার বারেবারে খাওয়া।এবং মনে রাখতে হবে যে ,গর্ভবতী অবস্থায় কখনোই উপবাস করা উচিত নয়।
● দাঁতের যত্ন নিতে হবে:-
গর্ভাবস্থায় মহিলারা দাঁতের মাড়ির ফুলে যাওয়া অনুভব করে থাকেন। রুটিন মাফিক দাঁত এবং দাঁতের মাড়ি পরীক্ষা করা এবং ক্যালশিয়ামে পূর্ণ খাবার খেলে এই সমস্যা কাটিয়ে উঠা সম্ভব।
●গর্বস্থায় ব্যায়াম :-
একজন গর্ভবর্তী মহিলা কতটা ব্যায়াম করবেন তা নির্ভর করে তিনি কী ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত তার উপর। কোনো নির্মাণ কাজে বা চাষবাসে নিযুক্ত গর্ভবতী মহিলার উচিত তার কাজের পরিমাণ কমিয়ে আনা, আবার একজন গৃহবধূ গর্ভবতী অবস্থায় খোলা জায়গায় নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করলে ভালো উপকার পাবেন, কিন্তু কোনো গর্ভবতী মহিলা যদি এক প্রকার কোনোরকম কাজের সঙ্গে যুক্ত না থাকেন তবে তাঁকে স্বাস্থ্যকর্মী নির্দেশিত ব্যায়ামগুলি নিয়মিত করা দরকার।
● বিশ্রাম নেওয়া:-
ভারী দৈহিক শ্রম যেমন ভারী কোনো জিনিস তুলে ধরা বা তা বয়ে নিয়ে যাওয়া, ঘণ্টার পর ঘন্টা হেঁটে যাওয়া, খননের কাজ ইত্যাদি এড়িয়ে চলতে হবে গর্ভাবস্থায়।গর্ভবতী মহিলা কখনই একটানা অনেকক্ষণ বসে বা দাঁড়িয়ে থাকবেন না। ভারী দৈহিক কাজের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে বিশ্রাম করার সময় বাড়াতে হবে গর্ভবতী মহিলাদের। দুপুরে অন্তত একঘণ্টা শুতে হবে এবং রাতে 6 – 10 ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন একজন গর্ভবতী মহিলার।এবং সুযোগ পেলেই বিশ্রাম নিতে হবে এবং অবশ্যই জানতে হবে কীভাবে নিজেকে শিথিল (Relax) করতে হয়।এছাড়াও গর্ভবতী মহিলার বিশ্রামের সময় সবচেয়ে ভালো অবস্থা হল বাঁদিকে শুয়ে পা সামান্য তুলে রেখে আরাম করা।
●মানসিক ভাবে পাশে থাকতে হবে:-
পরিবারের সকলে বিশেষত স্বামীকে বুঝতে হবে যে গর্ভবস্থায় মহিলাদের মনে নানা পরিবর্তন সুচিত হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে তাদের মানসিক সাহায্য করে গর্ভবর্তী মহিলাদের বোঝানো উচিত যে এটা একটা স্বাভাবির ঘটনা। এছাড়াও ভালোবাসা, আদর যত্ন, সম্মান যদি গর্ভাবস্থায় মহিলারা পেয়ে থাকেন তবে তাঁরা চাপমুক্ত হয় এবং গর্ভাবস্থায় তাঁরা মানসিক ভাবে শান্তি পেয়ে গর্ভাবস্থার দিনগুলি আনন্দে কাটাতে পারেন।যাতে গর্ভাবস্থায় মহিলারা ভয়, দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারেন সে জন্য তাদের উৎসাহ দিয়ে মনের নানা অনুভূতির প্রকাশ ঘটানো প্রয়োজন।
●গর্ভাবস্থায় যৌন সম্পর্ক :-
গর্ভবতী অবস্থায় মহিলাদের যে সমস্ত যৌন মিলন সম্পর্কিত বিষয় গুলো মনে রাখতে হবে-
ক) গর্ভাবস্থায় যৌন সংগমের ইচ্ছা বেড়ে যেতে বা কমে যেতে পারে এবং দুটি ইচ্ছাই কিন্তু এক্ষেত্রে স্বাভাবিক।
খ)গর্ভস্থ ভ্রূণ যখন স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠে তখন যৌন সংসর্গ গর্ভস্থ ভ্রুণ বা গর্ভবতী মহিলার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই ক্ষতিকারক নয়। কিন্তু কোনো মহিলা যৌনসংসর্গের সময় বা তার ঠিক পরে যদি দেখেন যে তাঁর যৌনাঙ্গ থেকে জলের মতো স্রাব বা রক্তপাত হচ্ছে বা যদি অকাল প্রসব বেদনার কোনো লক্ষণ দেখা যায় তাহলে যৌনসঙ্গম এড়িয়ে চলতে হবে। এছাড়াও গর্ভবস্থার 6 মাসের পর যৌনসঙ্গম অসুবিধাজনক।
গ)যদি কোনো গর্ভবতী মহিলার আগে কোনো গর্ভপাতের অভিজ্ঞতা থাকে তবে তার সাথে যৌনসম্পর্ক
গর্ভবস্থায় এড়িয়ে চলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এ ছাড়াও গর্ভবস্থায় প্রথম তিন মাসে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা
এড়িয়ে যেতে পারলে ভালো হয়।
ঘ)সহবাসে অস্বস্তি এড়াতে মহিলা এবং তাঁর যৌনসঙ্গী বিভিন্ন আসন বা তদি ব্যবহার করে দেখতে পারেন।
ঙ) গর্ভাবস্থায় পায়ুছিদ্র দিয়ে যৌন সক্ষম এড়িয়ে চলা উচিত যাতে করে বিভিন্ন এস. টি. আটের (যৌনসংসর্গ
জনিত সংক্রমণ) সংক্রমণের ঝুঁকি কমে যায়।
●ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি:-
এই সময় যে স্বাস্থ্যবিধি গুলো মেনে চলতে হয় সেগুলি হল-
১)প্রতিদিন স্নান করা।
২)প্রতিদিন এবং নিয়মিত জননাঙ্গ পরিষ্কার করা।
৩)পরিষ্কার, কাচা, সুতির এবং ঢিলেঢালা আরামদায়ক পোশাক পরা।
৪)স্তন পরিষ্কার রাখা, স্তনবৃত্ত যদি ছোটো এবং চাপা থাকে তবে আস্তে আস্তে উপরের দিকে টেনে তুলতে
হবে প্রতিদিন।
৫) পরিষ্কার এবং প্রবাহমান (Running Water)জল এবং মৃদু সাবান দিয়ে জননাঙ্গ এবং স্তন পরিষ্কার করতে হবে।
৬)মুখ এবং দাঁত প্রতিদিন পরিষ্কার করতে হবে যাতে করে কোনো সংক্রমণ না হয়।
৭)নিয়মিত ভাবে মাথার চুল ধোয়া এবং আঁচড়ানো প্রয়োজন।
৮)নিয়মিতভাবে বিছানার ঢাকা / চাদর (Bed cover) বদলে ফেলা এবং কেচে নেওয়া প্রয়োজন (প্রভৃতি)।
——————————————————