Special Correspondent
Global Newz, Kolkata
15th Jan’2024, Monday.
বিশ্ব মানের কবিতা ইয়াস -এর সমালোচনা
————————————
ঋদেনদিক মিত্রো ( ভারত)
কবিতার নাম ইয়াস। কবি ওয়াহিদা খাতুন। globalnewz.online নামের ওয়েবসাইট থেকে বেরিয়েছে। এটি “Potrika Nabarun ” হোয়াটসাপ গ্রুপ পত্রিকায় link পাঠিয়েছিলেন, কবি ওয়াহিদা খাতুন। প্রাসঙ্গিক কৃতজ্ঞতায় বলে রাখি, “Potrika Nabarun” হোয়াটসাপ গ্রুপ পত্রিকা শুরু হয় ২০১৭ সাল থেকে। বিভিন্ন কবি লেখক, শিক্ষাবিদ, পাঠকদের একসাথে এখানে নিয়ে আসেন মুর্শিদাবাদের নওদার কবি ও মুদ্রিত “নবারুণ” পত্রিকার সম্পাদক ও মুক্ত চিন্তার সমাজ সংস্কারক শীষ মহাম্মদ। সেখানে নতুন পরিচিত বন্ধু বন্ধবীরা একত্রে দিনরাত লিখতাম ও সমালোচনা করতাম। সেখানে অনেক অকবি কবি হয়ে ওঠে। অনেক কবি পরিনত কবি হয়। অনেক পরিনত কবি আরো বড় পরিনত কবি হয়। এখানকার কবি লেখকদের সফলতার রেকর্ড প্রমাণ দিতে পারে — এই গ্রুপ পত্রিকা বিশ্ব সাহিত্যের অনেক সেরা কাজের অংশীদার। আমিই এখানে আসার আগে পেশায় লেখক ছিলাম, কিন্তু এখানে ২০১৭ সাল থেকে যুক্ত হবার পরে আমার নানা বিধ দিকের অগ্রগতি দ্রুত হয়েছিল। এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই শীষ মহাম্মদের নাম আধুনিক মনস্ক সাংগঠনিক ব্যাবস্থাপক হিসেবে অমর থাকবে। এই “Potrika Nabarun” থেকে অনেকে ভালো কবি লেখক সমালোচক হয়েছেন তা-ই নয়, অনেকে ভালো পত্রিকা সম্পাদক হয়েছেন। কারণ, এই পত্রিকা গোষ্টি সকলের স্বপ্নকে ক্রমশ উচ্চতায় নিয়ে যেতে আত্মবিশ্বাস যোগিয়েছিল। যদিওবা এই শীষ মোহাম্মদের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় নদীয়ার তাঁতিগাছিতে সাংবাদিক বিধান ঘোষের দ্বারা ব্যাবস্থাপনায় অনুষ্ঠানে। বিষয়টি সংক্ষেপে সারলাম, কবিতার বিষয়ে আসবার জন্য।
এই Potrika Nabarun, এই হোয়াটসাপ গ্রুপ পত্রিকায় globalnewz.online পত্রিকায় প্রকাশিত “কবিতা ইয়াস” কবিতা link পোষ্ট করেন। সেটা দেখে আমি কবিতাটি ব্যাখ্যা করে দিয়েছিলাম ঐ গ্রুপ পত্রিকায়। এইসব হোউয়াটসাপ গ্রুপ পত্রিকায় নিজের পরিনত স্তর গড়ে তুলেতে নিজের উপস্থিতি আবশ্যক, আবার নিয়মের নথিতে লেখাগুলিকে মুদ্রনে বা ওয়েসসাইটে প্রকাশ করা অপরিহার্য। সেই কারণে এটি প্রকাশ করতে আগ্রহী হন কবি ওয়াহিদা, সম্পাদক শীষ মোহাম্মদ, এর আলোচক আমি ঋদেনদিক মিত্রো, এবং এই globalnewz.online ওয়েবসাইট পত্রিকার সম্পাদক। “Patrika Nabarun” গ্রুপ পত্রিকা ২০১৭ সাল থেকে শুরু হলেও ওয়াহিদা এখানে যোগদান করেন ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে, বা তারও একটু পরে। অন্যদিকে ওয়েবসাইটে পৃথিবীর বহু দেশে এই কবিতা পড়েছে ও পড়েছে এবং সেটা নিয়ে এই আলোচনাও পড়বে। এইভাবে সাহিত্যের পাঠক ও বিচারকগন এই স্বাদ গ্রহণ করবেন।
“globalnewz.online” সংবাদ সাহিত্য পত্রিকায় পূর্বের প্রকাশিত সেই কবিতাটি এটাই :—
🏞
কবিতা ইয়াস
ওয়াহিদা খাতুন
ইয়াস হয়ে ছিনিয়ে নিলে বসন্ত-বাহার !
সমূলে বিনাশ করে গেলে অসংখ্য অঙ্কুর —-
ধূধূ প্রান্তরের মানচিত্র গড়লে তাতে কি?
রোদ আলিঙ্গন করে রোজ, বৃষ্টি আশা দেয়;
আমার শাখাপ্রশাখাগুলো প্রাণ ফিরে পায়;
নুইয়ে পড়া বিক্ষিপ্ত কুড়ি রৌদ্রস্নানে যায়;
গুটি-গুটি পায়ে বলে দেখো —- ইয়াস, মরি নি—
আমার কান্ড ভেঙেছে তবু শিকড় মাটিতে;
কে আমাকে আঁকড়ে রেখে আবৃত রেখেছে—
এক বিপ্লবী রূপ দেওয়ার জন্য !
সেই ঝঞ্ঝার নিশুতি ডানা—আজো কানে বাজে ;
রণক্ষেত্রের মানচিত্রটা ভূমিকম্প হয়ে —-
স্বপ্ন-সমাধিকে আন্দোলিত করে বারবার—
ফিঙে-চোখে তা দিতেই থাকি সুপ্ত আশা-বীজে।
আজ খুবলে খাওয়া রোদ মধ্যগগনের
জমা মেঘকে ধাক্কা দিয়ে হেসে বৃষ্টি ঝরায়।
জালিকাকার জলসাঘরে কাকলি-সেতার —
বেজে ওঠে আনমনা ভরা পেয়ালার ঠোঁটে ।
নবপল্লবে বিপ্লবী হাসি নাচানাচি করে—
জ্যোৎস্না-কোলে বসে দোল খেতে-খেতে বলে ওঠে—-
ওয়াও! কত লাবণ্য-রূপ ও ফুলেল শয্যা—
চারিদিকে রণসজ্জা হয়ে স্বাধীনতা-ঝান্ডা তুলে
নভোশ্চরে বার্তা পাঠায় — আমরা জিতেছি ।
ও ইয়াস, দেখে যাও তুমি—-এখনো মরিনি—-
বৃক্ষ কখনো মরে না ইয়াস, আগাছা মরে;
বৃক্ষের শিকড়ের টান মাটির গভীরে ।
*******
[রচনাকাল : ০২/১২/২০২৩ বিকেল ৩টা বেজে ১৫ মিনিট]
———————————–
☕🥇
কবি ওয়াহিদা খাতুনের কবিতা ইয়াস নিয়ে বলতে গেলে একটু অন্য মাত্রায় কুরে-কুরে দেখতে হবে, এর অস্তিত্বের রন্ধ্রে কী আছে।
(১) কবিতা ইয়াস। নাম বলে দেয় এটা একটা গতি। কবির বিচার শক্তি এখানেই ভিন্ন বিচার শক্তিতে চলে, কারণ এখানে ইয়াস ছাড়া অন্য নামের ঝড় আসবে না।
(২) ইয়াস নামে যে-ধরনের strength ও বেপোরোয়ামির স্বাদ উপচে পড়ে, অন্য ঝড়ের নামে সেটা এই রচনায় খাপ খাবে না। আবার বলে দিই “ইয়াস” একটি ঝড়ের নাম।
(৩) কবিতার রোমান্টিকতা শুরু এইভাবে :–
” ইয়াস হয়ে ছিনিয়ে নিলে বসন্ত-বাহার!”
শুরুর technical application দেখুন। কী দুরন্ত। যেন এক যোদ্ধা একা ঘোড়ায় উঠে চাবুক দিল ঘোড়াকে। শুরু হল দৌড়।
(৪) পরের লাইনগুলি :–
সমূলে বিনাস করে গেলে অসংখ্য অঙ্কুর —
ধূধূ প্রান্তরের মানচিত্র গড়লে তাতে কি?
রোদ আলিঙ্গন করে রোজ, বৃষ্টি আশা দেয়।
###
এখানে ভাষার range ও প্রণম্যতা দেখার মত।
কে এই ইয়াস ? কবির সেই বিবরণী দেখছি,
“সমূলে বিনাস করে গেলে অসংখ্য অঙ্কুর —
ধূধূ প্রান্তরের মানচিত্র গড়লে তাতে কি?”
ঝড় অঙ্কুরকে নষ্ট করে না। গাছকে করে। কিন্তু এই ঝড়ের energy কত সুক্ষ্ম ও বেপরোয়া যে সে অসংখ্য অঅঙ্কুর ধ্বংস করতে সে স্বভাব সম্পন্ন।
meaning মেলে ধরা হয়েছে কোন দিকে।
তারপরের লাইনে :-
“ধূধূ প্রান্তরের মানচিত্র গড়লে তাতে কি?”
এই বাক্য আমাদেরকে বিশ্ব চিন্তার প্রান্তরে এনে দেয়। কী skill কবির!
তারপর :–
“রোদ আলিঙ্গন করে রোজ, বৃষ্টি আশা দেয়।”
রোদকে ব্যাবহার করা হয়েছে “আলিঙ্গন” শব্দ জুড়ে। কারণ রোদ আসে আমাদেরকে অন্ধকার থেকে মুক্তি দিতে। তাই তার মধ্যে আছে (A) ভালোবাসা (B) ত্যাগ (C) দায়িত্ব (D) সাহস (E) আত্মবিশ্বাস (F) প্রতি কাজেই তার জয়। (G) সে হারিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসে।
এইসব এত সুখের উলম্ফন আমরা পাই, কিন্তু খেয়াল করিনি। কবির দক্ষতা এখানেই, আমাদের কত দ্রুততার সাথে সতর্ক করিয়ে দেওয়া হলো এই বিষয়গুলো।
তার গায়ের লাইন হল :–
…বৃষ্টি আশা দেয়।
আমরা জানি বৃষ্টি জল দেয়। ডুবিয়ে দেয়। স্নান দেয়। বন্যা দেয়। তেষ্টা মেটায়। শষ্য দেয়।
“ইয়াস” এর কবির মতে :–
… বৃষ্টি আশা দেয়।
“বৃষ্টি” শব্দের সাথে “আশা”, কত দুরুহ কাজ। “আশা” শব্দের সাথে আছে সব কিছুর পূর্ণতা। আবার “আশা” শব্দে আছে সুস্থতার শীতলতার পাতলা হাওয়া। আবার “বৃষ্টি”র সাথে “আশা” জুড়ে যে পরিশীলিত image নিয়ে এলো তাতে ইয়াসের বেপোরোয়ামি হয়ে গেল ভদ্র। কবিতার মুন্সিয়ানায় এলো সলজ্জতা। আবার সেটার সাথে “দেয়” জুড়ে হল বাক্যটা :–
বৃষ্টি আশা দেয়।
এই “দেয়” শব্দটি আমাদের শরীরে মেখে গেলো যেন। তার পিছনে আছে “বৃষ্টি” ও “আশা”।
বৃষ্টি + আশা+ দেয় = এই তিন শব্দের চরিত্র আলাদা করে আলাদা রকম স্বাদ, সেটাও পাই। একত্রে আলাদা compound taste, সেটাও পাই। তার আগে আছে
“রোদ আলিঙ্গন করে রোজ”,
রোদকে আগে ব্যাখ্যা করেছি। সেই জিনিস বা গুণগুলির আলিঙ্গন আসার পরে বৃষ্টির উপস্থিতি এবং সেই বৃষ্টির সাথে সর্বোত্তম পাওয়ার উপস্থিতি, সেটা “আশা”।
এই যে design of method, এটা খুব কঠিন কাজ।
তারপরে কবির বক্তব্য :-
“আমার শাখাপ্রশাখাগুলো প্রাণ ফিরে পায়,
নুইয়ে পড়া বিক্ষিপ্ত কুঁড়ি রৌদ্র স্নানে যায়,
গুটি-গুটি পায়ে বলে, “দেখো ইয়াস, মরি নি,
আমার কান্ড ভেঙেছে, তবু শিকড় মাটিতে,
কে আমাকে আঁকড়ে রেখে আবৃত রেখেছে–
এক বিপ্লবী রূপ দেওয়ার জন্য। ”
বিপ্লবের কবিতার স্তর কোথায় নিয়ে যাওয়া যায়, সেটা এখানে লক্ষণীয়।
” আমার শাখাপ্রশাখাগুলো প্রাণ ফিরে পায়”
মানব সত্বার মুক্তির নির্জন বিহেমিয়ানতা হাঁপ ছেড়ে বাঁচালো যেন। এই ছবিটা চোখে আনার চেষ্টা করি আসুন, পাঠকগন, কেমন লাগে। এর detail ব্যাখ্যা অনেক বড়। আমি অতি সংক্ষেপে বলছি।
তারপর :–
“নুইয়ে পড়া বিক্ষিপ্ত কুঁড়ি রৌদ্র স্নানে যায়।”
ইয়াস দিয়েছিল অসংখ্য অংকুরে ঘা। তার ফলে কুঁড়ি বিপন্ন, অসহায় ও বিক্ষিপ্ত। কিন্তু তাকে রক্ষা করতে আসে বহুগুণ সম্পন্ন রোদ। রোদের উদারতা ও সাহসে স্নান সারে কুঁড়ি। এর মানে কুঁড়ি অসহায় হয়েছে, কিন্তু নিরাশ নয়।
Balance of thinking দেখুন, কত প্রকট এবং প্রচ্ছন্নতার মিশ্রণ।
“গুটি-গুটি পায়ে বলে, দেখো, ইয়াস, মরি নি–
আমার কান্ড ভেঙেছে, তবু শেকড় মাটিতে।”
ইয়াসকে অতি শুভ্রতায় সে সহজে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে সে মরেনি।
এই যে appeal of Trump, এটাই সৌখিনতা, এটাই লক্ষ্য করার মতো। কতটা নির্মেধ!
” আমার কান্ড ভেঙেছে, তবু শেকড় মাটিতে! ”
অংকুর এইভাবে চ্যালেঞ্জ করছে ইয়াসকে।
জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মহৎ বিচিত্র অসংখ্য বা বেহিসাবি অস্তিত্বগুলি নিজেদের ছোট-ছোট কাণ্ড নিয়েও গর্বিত। এর মানে হল, বাইরের বিরাট দানবীয় আক্রমণ সহেও প্রাণের গভীরে থাকা অনেক কিছু — তারা নিজেদের অমরতা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী।
তারপরে বলা হচ্ছে,
“কে আমাকে আঁকড়ে রেখে আবৃত রেখেছে!”
এই যে নিদারুণ সুখ, কেউ আমার বিপন্নতাকে আঁকড়ে রেখেছে। আবৃত রেখেছে। এর মাঝে আছে অনন্ত সুখ শান্তির মনোনিবেশ। অর্থাৎ মানব সত্বার সুখ মানে যন্ত্র সভ্যতার সুখ নয়, প্রচলিত নিয়মের খাদ্য সুখ, দেহ সুখ নয়। এর বাইরে এমন অনেক সুখ আছে লুকানো, সেগুলি অধ্যাত্ম সুখও নয়। কিন্তু সেই সুখ আরো বড়, ধর্মের নিয়মে সেই সুখ নেই। বাইরের জয়-পরাজয় নিয়েও সেই সুখ নেই। সেই সুখের সন্ধান আছে এই পংক্তিগুলোতে, কবির নিজস্ব আবিস্কার যেন।
“এক বিপ্লবী রূপ দেওয়ার জন্য।”
কত সহজে এই বিপুল সংবাদ জানিয়ে দেওয়া হলো এক নিমেশে।
কবির ভাষায় সেটা আমরা বুঝলাম যে, জীবনে সেরা পাওয়া হল বিপ্লবী রূপ। এর বাইরে সব ধুয়ে মুছে যায় ও যাবে।
এই পার্থিব সম্পদ, পদ, অহংকার, পুরস্কার, সুনাম, যৌবন, বার্ধক্য, বন্ধুত্ব, আত্মিয় ও মৃত্যু, সব কিছু পাওয়া হবে পরপর, চলেও যাবে পরপর। কিন্তু সত্বার গভীরে বিপ্লবী রূপ, সে থাকবে এই অনন্তলোকে অমৃতের সন্ধান হয়ে।
ভাবতে পারেন, কবির এই পংক্তি কিভাবে নিয়ে গেলো কোন প্রাপ্তির অহংকারে! মহৎ অহংকারে। সেই অহংকার আজোবধি আমরা খুঁজে পাইনি।
কবির সংকেত হল, এই জীব প্রাণে সুখ আছে, কোনো দুঃখ নেই।
যেখানে সব কবিরা বলেন, ধর্মগুরুরা বলেন, দুঃখ ও সুখ নিয়ে জীবন। সেখানে “কবিতা ইয়াস” কবিতায় আমরা জানতে পারলাম, জীবন মানে সুখ। আর কিছু নয়। যদি এইভাবেই আমাদের অসংখ্য অঙ্কুরের অস্তিত্বকে চিনতে পারি ও তাদের চরিত্রকে বুঝতে পারি।
(৫) সেই ঝঞ্ঝার নিশুতি ডানা — আজো কানে বাজে।
রনক্ষেত্রের মানচিত্রটা ভূমিকম্প হয়ে —
স্বপ্ন-সমাধিকে আন্দোলিত করে বারবার —
ফিঙে-চোখে তা দিতেই থাকি সুপ্ত আশা-বীজে।
#
এবার পংক্তিগুলি ভাঙছি,
সেই ঝঞ্ঝার নিশুতি ডানা — আজো কানে বাজে।
এখানে কবির বক্তব্য হল যে, এই অমূল্য স্মৃতি কানে লেগে আছে। জীবনের অনেক কিছু স্মৃতি থেকে মুছে যায়, যাবে, কিন্তু এই স্মৃতি মুছে যাবে না। কারণ এই স্মৃতির সাথে আছে বিপ্লবী রূপের স্মৃতি। এই চিন্তার মহীরুহতা কতটা আপন করে নিল আমাদের পাঠক মন।
“রনক্ষেত্রের মানচিত্রটা ভূমিকম্প হয়ে —
স্বপ্ন-সমাধিকে আন্দোলিত করে বারবার —”
সেই গোপন নিয়মের যুদ্ধ ও বশ্যতা স্বীকার না করার কাহিনী পুরোটাই কবির মনকে আন্দোলিত করে ভূমিকম্পের মত। মানে, এর বিস্তৃতি কতদূরে!
“ফিঙে-চোখে তা দিতেই বাকি সুপ্ত আশা-বীজে।”
দেখা গেল কবির পরের ধাপ। ফিঙে + চোখ।
এখানে নিরন্তর মুগ্ধতায় কত সন্তর্পণতা খেলা করছে, দেখবার মত।
তারসাথে:–
তা + দিয়ে + আশা + বীজে।
এই চারটি শব্দের জুড়ায় চিন্তার স্তর কোনো পটভূমি গড়ে তোলে বিরাট নির্মানের মত। সত্যি, অতুলনীয়। এটা ব্যাখ্যা করলেও আরো অনেক দূর এগুবে। পাঠক বুঝে নেবেন।
(৬) আজ খুবলে খাওয়া রোদ মধ্যগগনের
জমা মেঘকে ধাক্কা দিয়ে হেসে বৃষ্টি ঝরায়।
—
কবির মুন্সিয়ানা জলের তলা থেকে মাছ উপরে ভেসে যাওয়ার মত ভাসিয়ে দিল পুরো কবিতার মানদণ্ডকে, কত আয়াসের সাথে।
“খুবলে + খাওয়া + রোদ”
এই তিনটে শব্দ আলাদা রূপে একরকম, জুড়ে আরেকরকম। তার সাথে জুড়ল ” মধ্যগগনের”, তার সাথে জুড়ল : —
জমা মেঘকে ধাক্কা দিয়ে এসে বৃষ্টি ঝরায়।
—
এ যেন খরার জন্য চাতক ভিক্ষা চাইছিল বৃষ্টি। কবির কলম যেন সেই অভিনিবেশকে সাথি করে এনে দিল সেই অধরাকে ধরার সুখ। এইভাবে।
(৭) জালিকাকার জলসাঘরে কাকলি-সেতার —
বেজে ওঠে আনমনা ভরা পেয়ালার ঠোঁটে।
—
এবার কবির বক্তব্য হল,
একটি জালিকাকার বা তারের জাল ঘেরা জলসাঘর, এর মানে সহজ চোখে পুরোটা দেখা যাবেনা বাইরে দাঁড়িয়ে। তাই ভিতরে ঢুকতে হবে অনেক মূল্যের বিনিময়ে সেই আনন্দ পেতে। সেখানে যে-নর্তকী আছে সে এত সহজে প্রাপ্য নয়। কেউ-কেউ তাকে পেতে পারে।
” কাকলি-সেতার বেজে ওঠে আনমনা ভরা পেয়ালার ঠোঁটে।”
এখানে মদ এর উল্লেখ নেই। কিন্তু “ভরা পেয়ালা” দিয়ে বুঝানো হল এখানে মদ আছে, যৌনতা আছে। কিন্তু সেই যৌনতার প্রাপ্তি সবাই পায় না। সেই যৌনতার প্রাপ্তি সবার জন্য নয়। কারণ সেটা তথাকথিত যৌনতা থেকে আলাদা নিয়ম।
(৮) নবপল্লবে বিপ্লবী হাসি নাচানাচি করে,
“বিপ্লবী হাসি” মানে সেটা আক্রোশে নিরস হবে তা নয়, বিপ্লবের হাসিও হয় নবপল্লবের হাসির নাচের মত।।
এই প্রকরণে আনন্দের সমন্বয়, আমরা নতুন জানলাম, কবিতার পাঠক পাঠিকা।
(৯) জ্যোৎস্না-কোলে বসে দোল খেতে-খেতে বলে ওঠে —
ওয়াও, কত লবণ্য-রূপ ও ফুলেল শয্যা —
চারিদিকে রন সজ্জা হয়ে স্বাধীনতা ঝান্ডা তুলে —
নভোশ্চরে বার্তা পাঠায় — আমরা জিতেছি।
ও ইয়াস, দেখে যাও তুমি, এখোনো মরিনি।
—
মানব সত্ত্বার জয়কে কিভাবে দৃশ্যগ্রাহ্য করা যেতে পারে, সেই পরম লোভনীয় ব্যাপারটি আমাদের চোখে অচেনা ছিল। তাই আমাদের বেঁচে থাকায় এত দুঃখ ছিল। সেই দুঃখ থেকে বের করে আনার এই পন্থা কবির নিজস্ব উদ্ভাবন।
পংক্তিগুলি দেখুন এক-এক করে।
নবপল্লবে বিপ্লবী হাসি নাচানাচি করে,
এরপর কী করলো দেখুন–
“জ্যোৎস্না-কোলে বসে দোল খেতে-খেতে বলে ওঠে — ”
এই বক্তব্যের সীমানা কোথায় দাঁড় করানো হলো!
চারিদিকে রণসজ্জা হয়ে স্বাধীনতা-ঝান্ডা তুলে
নভোশ্চরে বার্তা পাঠায় — আমরা জিতেছি।
—
এই জয় পৃথিবীর জয় শুধু নয়, কবি এই জয়ের ব্যাপ্তি বুঝাতে আমাদের চোখকে মনস্ক করে দিতে সমর্থ এইভাবে —
নভোশ্চরে বার্তা পাঠায় — আমরা জিতেছি।
এই জয় মহাবিশ্বের মাঝে গর্ব করার মতো।
অর্থাৎ মানব সত্বার অস্তিত্ব রক্ষা হতে পারে এই ধরনের জয় দিয়ে এই অনন্তলোকে।
তারপর কবির উল্লাস :–
ও ইয়াস, দেখে যাও তুমি, এখোনো মরিনি।
কী অনায়াস সুনিপুন নম্রতা দিয়ে বিরাট ঝড়কে সমীহ দিয়ে ঘোষনা করে দেওয়া,
ও ইয়াস, দেখে যাও তুমি, এখোনো মরিনি।
(১০) বৃক্ষ কখোনো মরেনা ইয়াস, আগাছা মরে,
বৃক্ষের শিকড়ের টান মাটির গভীরে।
—
পাঠক পাঠিকা দেখুন,
শেষ দুটি পংক্তি কিভাবে লেখা হল,
ইয়াসকে কবির challenge,
বৃক্ষ কখোনো মরেনা ইয়াস, আগাছা মরে।
নেতিবাচক মানব মনকে কিভাবে বোঝানো হল এখানে —
আগাছা মরে।
কী অভিনব কৌশলে প্রয়োগ সকলের জানা এই শব্দকে।
তারপর লেখা :–
বৃক্ষের শিকড়ের টান মাটির ভিতরে,
তারপর কবির এই বাক্য আমাদের আবার প্রথিত করে দিল চিন্তার নিঃশব্দতায়।
আমরা হলাম এই নতুন নিয়মে সূর্যালোকে পুণ্য স্থান করে আসা নতুন প্রাণ স্পন্দন।
এই কবিতা পৃথিবীর সেরা কবিতাগুলির একটি, এবং হয় তো আধুনিকতম সেরা বিপ্লবী কবিতা।
এই কবি এই দেশ ও বিদেশের সেরা কবিদের মধ্যে একজন। কোনো পক্ষপাতিত্ব না করেই বলছি, বাংলা কবিতায় এই রকম কবি আছেন, তাঁরা সকলেই নিজের নিয়মে নতুন আদল, তাঁদের মধ্যে এই কবি একজন।
এবং বিপ্লবের কবিতায় হয় তো পৃথিবীতে এই কবিতা সবচেয়ে আধুনিক ও রোমান্টিক।
বাকি বিচার অন্য জ্ঞানী সমালোচকদের উপরে থাকলো। কারণ, সমালোচনা হল সমুদ্রের মত সুদূরপ্রসারী।
— — —
এই কবিতা যাঁর লেখা তাঁর সংক্ষিত পরিচয় দিলাম, তাঁর এই লেখনি সফলতার সত্যতার কারণ বুঝাতে, যেটা সমালোচকদের সহায়তা করবে।
ওয়াহিদা খাতুন, ( Wahida Khatun, West Bengal. India, a poetess, Lyricist, Teacher and a social reformer. ) , একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে সাহিত্যের শিক্ষিকা ও সম দায়িত্বে একজন কবি, গীতিকার। মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত। ২০২১ সালে অডিশনে পাস করে Zodiak Muzik House কোম্পানীর স্টাফ গীতিকার গ্রুপের একজন হয়েছেন। বাংলাভাষা থেকে প্রায় আড়াইশ প্রতিযোগীর মধ্যে পাস করা মাত্র পনেরো জনের মধ্যে উনিও একজন। কলিকাতার এক প্রকাশনী থেকে বেরুচ্ছে এক শত কুড়িটি বাংলা সনেটের সংকলন গ্রন্থ। ” ভয় ” এই পূর্ণ দৈর্ঘের সিনেমায় দুটি গান লিখেছেন। সিনেমা রিলিজড হয়েছে ২০২৩, এপ্রিলে। সিনেমা ও ইউটুবে রিলিজ হওয়া অনেক গান ইউটুবে পাবেন। অয়ন্তিকা চক্রবর্তী, বিদুষী হৈমন্তি শুক্লা, কুমার চঞ্চল, সুপ্রীতি বিশ্বাস হালদার, মৌ আচার্য, সোমিন্দ্র কুমার, মিস প্রীতি, মৌসুমী দাশগুপ্তা, শৈবাল চৌধুরী, প্রমুখ অনেকেই ওয়াহিদার গান গেয়েছেন ও গাইছেন। প্রথম প্রকাশিত বাংলা গান ” কেনো কাঁদো মা গো আমার “, সুর আর-কে-পাল, Mother voice : অয়ন্তিকা চক্রবর্তী, ও প্রথম প্রকাশিত ইংরেজি গান ” We are all brothers in the world “, Music ; Kumar Chanchal, Mother Voice : Mou Acharjee. দিয়েই সংগীতের মাঠে নেমেছিলেন। তারপর পরপর পথ চলেছে। সাহিত্যের বহু বিষয়ে কাজ করতে চান। ২০২৩, নভেম্বরে, কবিতা ও সঙ্গীত রচনার জন্য আসামে পেলেন আন্তর্জাতিক স্বর্ণ পদক, মাদার টেরেজা গোল্ড এওয়ার্ড ও ড. ভূপেন হাজারিকা স্মৃতি সম্মাননা স্মারক। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, সংকলন ও ওয়েবসাইটে উপস্থিত।
————————