নিজস্ব প্রতিনিধি,
গ্লোবাল নিউজ, কলকাতা,
৪থ’ নভেম্বর’২০২৩, শনিবার,
‘মাদকাসক্তি’ সমস্যার লক্ষণ ও চিকিৎসা
– জয়দেব বেরা
‘মাদক’ হল সেই বস্তু যা ব্যবহার করলে মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, মস্তিষ্কের ক্রিয়াশীলতা হ্রাস পায়, একটা ঘোর-ঘোর অবস্থার মধ্যে থাকে এবং ওই নির্দিষ্ট বস্তুটির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ওই নির্ভরতা এতটাই যেন নির্দিষ্ট মাদকটি ছাড়া শারীরিক ক্রিয়াকলাপ বন্ধ হবার উপক্রম হয়। মাদক এক রাসায়নিক দ্রব্য যা মূলত বিভিন্ন গাছের শিকড় থেকে শুরু করে ফল-ফুল-পাতা, নানা অংশের নির্যাস দিয়ে তৈরি হয়। এই সব দ্রব্য যখন চিকিৎসাগত কারণ ছাড়াই ঘনঘন ব্যবহার করা হয়, তখন তাকে বলা হয় মাদকাসক্তি।বিশ্বজুড়ে নানা ধরনের মাদক ব্যবহৃত হয়। কিছু কিছু মাদকদ্রব্য মানুষ নিজেই তৈরি করে ব্যবহার করে, আবার অনেক মাদকবস্তু অর্থের বিনিময়ে বাজার থেকে সংগ্রহ করা হয়— সাধারণত গোপনে। মোটামুটিভাবে যে সব মাদকদ্রব্য বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয় সেগুলি হল – ক্যানাবিস, গুড়াকু,অ্যাঞ্জেল ডাস্ট,আফিম,তামাক, কোকেন, ব্রাউন সুগার, হেরোইন, গাঁজা, এল. এস. ডি., হ্যাপি পাউডার, ম্যানড্রাক্স প্রভৃতি।এই সমস্ত দ্রব্য গুলো ব্যক্তিকে চরম নেশায় আচ্ছন্ন করে রাখে।এই মাদকদ্রব্য গুলিকে আবার কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন- ১) বেদনা উপসমকারী, ২)উত্তেজক মাদকদ্রব্য,৩)অবসাদ সৃষ্টিকারী,৪)স্নায়বিক উত্তেজনা প্রশমনকারী,৫)বিভ্রম সৃষ্টিকারী,৬)নাসিকায় গ্রহণযোগ্য।এই মাদক গুলোকে নাক বা মুখ দিয়ে বা ইনজেকশন এর মাধ্যমে গ্ৰহণ করা হয়।
●মাদকাসক্তির লক্ষণ:-
মাদকাসক্তি হল একধরনের সামাজিক ও মানসিক ব্যাধি।এই সমস্যার লক্ষণ গুলি হল-
১) খেলাধুলা থেকে শুরু করে পড়াশোনা, গৃহস্থালির কাজকর্ম ইত্যাদি দৈনন্দিন জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনীহার ভাব লক্ষ্য করা যায়।অর্থাৎ কোনো কিছুতেই উৎসাহ পাবে না।
২) যৌন ইচ্ছা,ক্ষুধা এবং প্রতিবাদ স্পৃহার মত স্বাভাবিক জৈবিক প্রবৃত্তিগুলি অবদমিত হতে থাকে।
৩) কথাবার্তার মধ্যে অসংলগ্নতার ভাব প্রকট হতে থাকে।
৪) হাঁটাচলা বা কাজ করার মধ্যে উদ্দেশ্যহীনতা প্রকাশ পায়।
৫) শরীরে ইনজেকশন নেবার দাগ থাকতে পারে বা পরিধেয় জামাকাপড়ে ছোটো আকারে রক্তের দাগ থাকতে পারে।
৬) বমিবমি ভাব এবং শরীরে যন্ত্রণাবোধ বা অস্বস্তি লক্ষ্য করা যায়।
৭) একটানা বেশ কিছুক্ষণ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকা সম্ভব হয় না। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে।
৮) মানসিকতায় ঘনঘন পরিবর্তন হয়। ভাবনাচিন্তায় কোনো স্থিরতা থাকে না। মনোনিবেশজনিত সমস্য হয়।
৯) সবসময় মানসিক অবসাদ লক্ষ্য করা যায়। উৎফুল্লতা সাময়িক (Sports personalities) তারপর
অবসান।(প্রভৃতি)
১০)সামাজিক ও মানসিকভাবে দুর্বলতা।
●মাদকাসক্তির কারণ-
কোনো ব্যক্তি জন্মগতভাবে মাদকে আসক্ত হয় না।এই মাদকাসক্তির পেছনে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও মানসিক কারণ রয়েছে।এই কারণ গুলো হল-
১)দারিদ্র্য-
ড. রাধাকমল মুখোপাধ্যায় এর মতে,এই ধরনের পরিস্থিতি মানুষকে অপরাধপ্রবণ করে তোলার অনুকূল।দারিদ্র্যের এক জ্বালা আছে, অসহায়তা আছে। সেই অসহায়তা এবং জ্বালা জুড়োতে মানুষ কখনো কখনো মাদকের আশ্রয় নেয়। এক মাদক মুক্তি ক্লিনিকে চিকিৎসার জন্য আসা ৭০৭ জন মাদকাসক্তের উপর সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং হতদরিদ্র মানুষের সম্মিলিত হার দাঁড়াচ্ছে ৩২.৪০। অর্থাৎ মোট মাদকসেবনকারীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ দারিদ্র্য পীড়িত পরিবারের সদস্য। ক্ষুধাদমন করতে, মানসিক যন্ত্রণা ভুলতে, বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসকারী মানুষের নিরানন্দময়তা দূর করতে মাদকদ্রব্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
২)বিশৃঙ্খল পরিবার-
বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানীর মতে, শৃঙ্খলাহীন একটি পরিবারে কোনো ব্যক্তি উপযুক্ত মানসিকতা অর্জন করতে পারে না এবং উদবেগ ও আবিলতা পরিবার জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠে। পরিবারের মধ্যে বন্ধনহীনতা এবং বিশৃঙ্খলা মানুষকে যে সব প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত রাখে তা ব্যক্তিমনকে ধ্বংসাত্মক হতে প্রবৃত্ত করে। এভাবে নিজেকে ধ্বংস করার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার মাদকদ্রব্য গ্রহণ সমেত নানা অসামাজিক কাজের সঙ্গে তারা জড়িয়ে পড়ে।
৩) ক্ষতিকারক বন্ধুবান্ধব-
মানুষ সাধারণভাবে বন্ধুবৎসল। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সময় কাটানো এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া মানুষের জীবনে একটি স্বতঃসিদ্ধ ঘটনা। কিন্তু সকলেই যে ভালো বস্তুর সংস্পর্শে জীবন কাটাতে পারবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বস্তুতপক্ষে ক্ষতিকারক বছর সান্নিধ্য পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। ক্ষতিকারক বন্ধুর কুসংসর্গে একটি মানুষের পক্ষে বিপথে চালিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। অধিকাংশ অপরাধমূলক কাজই কোনো না কোনো গোষ্ঠীর দ্বারা সংঘটিত হতে দেখা যায়। মাদকদ্রব্য ব্যবহারকারীদের সঙ্গে আলোচনাও এই সত্যকে প্রকট করে যে তাদের মধ্যে একটি বড়ো সংখ্যাই বন্ধুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই পথে এসেছে। একটি সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে ৩৮.২১ ভাগ মাদকাসক্ত এর প্রভাবে পড়েছে বন্ধুদের কুসংসর্গের জন্য।
৪) মানসিক চাপ –
মাদকাসর হওয়ার এটিও অন্যতম প্রধান কারণ। কখনো কখনো মানুষ খুব মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে। ব্যাবসা ভালো না চলা বা ক্ষতি হওয়া, চাকুরিতে উন্নতি না হওয়া, ক্রমাগত প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকতে বাধ্য হওয়া, স্ত্রী বা স্বামীকে সন্দেহের চোখে দেখা, সম্পত্তি থেকে বর্ণিত হওয়ার সম্ভাবনা, ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যাত হওয়া, কারও কাছে ক্রমাগত অপমানজনক ব্যবহার পাওয়া, ঘনিষ্ঠ কারো দুরারোগ্য ব্যধি, ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়া, অত্যন্ত আপনজনের অকালমৃত্যু, অভিভাবকের সীমাহীন প্রত্যাশার সঙ্গে তাল রাখতে পা পারা, পছন্দ নয় এমন কাজ করতে বাধ্য হওয়া, অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জন করা, কর ফাঁকি দেওয়া, ইত্যাদি বহুবিধ কারণে মানুষ মানসিক চাপের শিকার হয়। চাপ অসহনীয় হয়ে উঠলে অনেকে মাদকদ্রব্যের আশ্রয় নেয়।
৫)মজা করতে গিয়ে –
‘আমি বড়ো হচ্ছি’ এই ভাবনাটা অনেক কিশোর- কিশোরী, তরুণ-তরুণীকে খারাপ কাজেও প্রবৃত্ত করে। মজা করার নানান বিষয়ের মধ্যে মাদকদ্রব্য সেবন অন্যতম। দু’চারদিন মজা করে কোনো মাদকদ্রব্য খেতে গিয়ে নিজের অজান্তেই ধীরে ধীরে মাদকের শিকার হয়ে উঠে।
৬)সামাজিক অবস্থা-
সন্তানদের অবহেলা অথবা তোষামুদি করা,অতিরিক্ত আদর, প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত হাতখরচের অর্থ দেওয়া,সন্তানের প্রতি সচেতন না থাকা, মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা সবকিছু মিলিয়ে এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যা মাদকাসক্তি সমস্যাকে দিন দিন উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছে দিচ্ছে।
●মাদকাসক্তির চিকিৎসা ব্যবস্থা:-
মাদকাসক্তি হল মূলত একধরনের সামাজিক ও মানসিক সমস্যা।এই সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে শরীরের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর আকার ধারণ করে।এই সমস্যার ফলে ব্যক্তির সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি শারীরিক স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোনো মাদকাসত্ব ব্যক্তির সঠিক চিকিৎসা করতে হলে তার দৈহিক পরীক্ষা, মানসিক পরীক্ষা, ব্যবহারের ইতিহাস জানা, পারিবারিক পরিবেশ সম্পর্কে অবহিত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এই সমস্ত পরীক্ষার জন্য এবং তথ্যের ভিত্তিতে হাসপাতাল, নার্সিং হোম বা মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে অর্থাৎ পুনর্বাসনকেন্দ্রে বিশেষ ধরনের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়।প্রয়োজন হলে ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের চিকিৎসা চালু করতে হবে।এই সমস্যার একটি অন্যতম চিকিৎসা পদ্ধতি হল “ডিটক্সিফিকেশন” প্রক্রিয়া(একধরনের আসক্তি মূলক চিকিৎসা)। যদিও এই পদ্ধতি যথেষ্ট জটিল।পেশাদার চিকিৎসকরাই করে থাকেন। এই সমস্যার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং মনোচিকিৎসকের চিকিৎসায় সুফল পেতে হলে চিকিৎসা চলাকালীন এবং তৎপরবর্তীকালে তাকে উপযুক্ত পর্যবেক্ষণে রাখতে হয় ও প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে হয় এবং মানসিকভাবে সে যাতে বিপর্যস্ত হয়ে না পড়ে সেজন্য সামাজিক ও মানসিক ভাবে পাশে থাকতে হয়।এই সমস্ত ব্যক্তিদেরকে প্রয়োজনমত সাইকোথেরাপি এবং কাউন্সেলিং ও করানো উচিত।কারণ এই সমস্যার অন্যতম একটি চিকিৎসা পদ্ধতি হল-“সাইকোথেরাপি এবং কাউন্সেলিং”। এই ধরণের চিকিৎসার জন্য বড়ো বড়ো সরকারি হাসপাতালে এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের বিশেষ চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোও গড়ে তোলা হয়েছে। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় এই ব্যবস্থা অপ্রতুল।
এই জাতীয় চিকিৎসায় চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী এবং কাউন্সেলর ছাড়াও পরিবারের সদস্যদেরও এক বিশেষ ভূমিকা আছে। ধৈর্য ও সহানুভূতি নিয়ে আসক্ত সদস্যের পাশে দাঁড়ানো,মানসিক শক্তি জোগানো, উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখার ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।মাদকাসক্তি ব্যক্তিদের পাশে সামাজিক ও মানসিক ভাবে সবসময় থাকতে হবে।এই সমস্যা সমাধান করতে হলে বিভিন্ন আধুনিক মেডিক্যাল চিকিৎসার পাশাপাশি সামাজিক ও মানিসিক চিকিৎসাও করতে হবে।বিভিন্ন মোটিভেশন মূলক সেমিনার এর আয়োজন করতে হবে।তাদের প্রতি কোনরূপ সামাজিক বৈষম্য করা চলবে না।স্বাভাবিক ভাবেই তাদের সঙ্গে আচরণ করতে হবে।সবচেয়ে বড় কথা সামাজিক ও মানসিক ভাবে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।যতদিন না তারা স্বাভাবিক ভাবে জীবনের মূলস্রোতে ফিরছে ততদিন অবধি এই সমস্ত পদ্ধতি বা থেরাপি চালিয়ে যেতে হবে।এই ধরণের চিকিৎসা বড় বড় হাসপাতালের পাশাপাশি মূলত হয়ে থাকে পুনর্বাসনকেন্দ্রে (Rehabilitation Centre)।
●(লেখক একজন তরুণ কবি ,প্রাবন্ধিক,সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক এবং গেস্ট লেকচারার,সমাজতত্ত্ব,
সেবাব্রত ইনস্টিটিউট অফ নার্সিং এবং গভর্মেন্ট কলেজ অফ নার্সিং,শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গভর্মেন্ট মেডিক্যাল কলেজ এন্ড হসপিটাল,উলুবেড়িয়া)।